Header Ads

জোছনা ও জননীর গল্প

জোছনা ও জননীর গল্প (২০০৪); হুমায়ূন আহমেদ : ৮.৮

“রংপেন্সিল” এ হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন, যখন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই থাকলেও আপনার কেন নেই? জবাবে তিনি সন্তর্পনে বলেছিলেন, কারণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ দেখেন নি। এখানে তার মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তার লেখার গুরুত্বটা প্রতীয়মান হয়। আর তাই দেশমাতার ঋণ শোধ করার জন্য গুলতেকিনের দেওয়া ৫০০ পৃষ্ঠার খাতায় “জোছনা ও জননী গল্প”র বুনতে শুরু করেন।
৯৩টা রেফারেন্স ঘাটার মত অমানবিক পরিশ্রম, পাশাপাশি নিজের চোখে দেখা যুদ্ধটাকে তিনি রূপ দিয়েছিলেন ৫০৫ পৃষ্ঠায়, যা স্পষ্টই এর মানের দিকটা বোঝায়। সেই ভয়াল সময়ের কিছু মানুষের হাত ধরে এগোতে থাকে কাহিনী, যেখানে আলাদাভাবে কেউ নায়ক নয়, কিন্তু ফুটিয়ে তুলেছেন দেশবাসীর হতাশা, ক্ষোভ, আনন্দ আর বিজয়ের অনুভুতিগুলো। কখনও ছুড়ে দিয়েছেন তার স্বভাব সুলভ এপিগ্রাম –“অক্ষম আর দুর্বল পুরুষেরাই শুধু স্ত্রীর সাথে রাগারাগি করে।“ হুমায়ূন আহমেদের অন্য লেখাগুলোর মতো সাবলীল শুরুটা আপনাকে সরাসরি উপন্যাসটিতে নিয়ে যাবে। যদিও গল্পের মাঝের দিকে সংলাপকে স্থবির মনে হয়। তবুও লেখনীর মায়া জালে হুমায়ূন আহমেদ প্রতি পাতায় তার পাঠককে আটকিয়ে রেখেছেন, বসিয়ে রেখেছেন জোর করে, পাঠককে অত্যাচারের এক অনন্য নিদর্শন।
ঘটনাক্রম শুরু হয়, ফাল্গুনের শুরুতে অর্থ্যাৎ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে; ইরতাজ উদ্দিন নামক স্কুল শিক্ষকের ঢাকায় আসাকে কেন্দ্র করে। সে আসে তার ছোট ভাই শাহেদের সাথে দেখা করতে। শাহেদ, আসমানী আর তাদের ছোট মেয়ে রুমিকে নিয়ে তাদের ছোট সংসার যেখানে অল্প-স্বল্প অভিমান বা ভুল বোঝাবুঝিতে আসমানী মেয়ে সমেত বাবার বাসায় যায়। এরই পুনরাবিত্তি হয় ২৫ মার্চ। সেই ভইয়াল কালরাত্রিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তারা, আসমানী ও রুমী মিশে যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে। শাহেদ আর আসমানী আবার সেই খুনসুটি নিয়ে তাদের সংসার শুরু করতে পারবে কিনা তা জানার ইচ্ছা আপনাকে আটকে রাখবে শেষ পর্যন্ত।
এর পাশেই সমান্তরালে চলতে থাকে আরেক চরিত্র; যেখানে নাইমুল নামের ছেলেটা বিয়ে করে মরিইয়মকে। স্বাধীন দেশে ফিরবার কথা বলে যুদ্ধে যায় নাইমুল। এই সম্পর্কের শেষটা জানতে আপনি মনে অজান্তেই দ্রুত পৃষ্ঠা উল্টিয়ে যাবেন।
এছাড়াও উপন্যাসে উল্লেখ আছে কবি শামসুর রহমান, মাওলানা আব্দুল হামীদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, ইন্দিরা গান্ধী, ভুট্টো, টিক্কা খান সহ সমসাময়িক সব ব্যক্তিদের কথা। এসব নামিদামি চরিত্রের পাশাপাশি বাদ যায় নি কলিমুদ্দিনের মতো লোকগুলো, যারা স্বাধীনতার আভাস পাওয়া মাত্রই মুখোশ বদলিয়ে দল পরিবর্তন করে; স্ত্রীর সবুজ শাড়ি দিয়ে পতাকা বানায়।
লেখক সাহসী বাঙ্গালীরদের যুদ্ধ কৌশল তুলে এনেছেন, যা পড়ে হঠাৎই বলে উঠবেন, ‘দেখ, কেমন লাগে?’ গল্পের এক পর্যায়ে লেখক তার ভাই ও মাকে নিয়ে পালানো অভিজ্ঞতাও ব্যক্ত করেন।
উপন্যাসটি অন্যতম গুণ হলো, ছোটখাট বিষয়গুলোও লেখকের দৃষ্টি এড়োয়নি। যেমন, শেষে নিয়াজী যখন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সাথে হাত মেলাতে চায়, তখন কাদের সিদ্দিকী না করে দিয়ে বলেন, ‘যারা শিশু ও নারীদের নির্যাতন করে, তাদের সাথে আমি হাত মিলাই না।‘
সর্বোপরি, বিজয়ের দিনে লেখকের বন্ধু আনিসের স্বাধীন দেশের রাস্তায় হাত পা ছড়িয়ে গড়াগড়ি খেয়ে কাদার দৃশ্য আপনাকে স্বাধীনতার অনুভূতি কিছুটা হলেও অনুভব করাবে, যা এই স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে কখনই পারবেন না।


মোঃ রাজিবুল ইসলাম
কনীনিকা কুঞ্জ, নারুলী।।


No comments

Powered by Blogger.