বাদশাহ নামদার
বাদশাহ নামদার (২০১১);
হুমায়ূন আহমেদ : ৮.৩
কোন এক জায়গায়
থাকতে থাকতে ক্লান্ত হলে যেমন হাওয়া বদল প্রয়োজন
হয়, তেমনি হুমায়ূন আহমেদ তার লেখনীর হাওয়াবদলের জন্য লিখেছিলেন “বাদশাহ নামদার”। কারণ
এ সম্পর্কে লেখক ভূমিকাতে বলেন,
"সব ঔপন্যাসিকই বিচিত্র চরিত্র নিয়ে কাজ করতে ভালবাসেন। এই অর্থে হুমায়ূন অতি বিচিত্র এক চরিত্র। যেখানে তিনি সাঁতারই জানেন না সেখানে সারাটা জীবন তাঁকে সাঁতরাতে হয়েছে স্রোতের বিপরীতে। তাঁর সময়টাও ছিল অদ্ভূত। বিচিত্র চরিত্র এবং বিচিত্র সময় ধরার লোভ থেকে 'বাদশাহ নামদার' লেখা হতে পারে। আমি নিশ্চিত না।"
ইতিহাসকে
কেন্দ্র করে লেখক যে গুটিকয়েক উপন্যাস লিখেছেন তার মধ্যে এটি অন্যতম। সেই ভারতীয় উপমহাদেশে
মোঘলদের উত্থান পতনের এক সুরময় ছন্দ দিয়ে গেছেন এই উপন্যাসে। কোন সম্রাটের জীবনীকে
এমন এক উপন্যাসে রূপ দেয়া যায়, তা এই বই না পড়লে বোঝা সম্ভব না।
উপন্যাসের
মূল চরিত্র মুহাম্মদ হুমায়ুন মির্জা; যিনি পিতার দিক থেকে তৈমুর লং –এর বংশধর। তার
বাবা মির্জা জহির উদ্-দিন মুহাম্মদ বাবর মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। বাবরের শাসনামলের
শেষ এবং হুমায়ুনের দায়িত্বগ্রহনের মাধ্যমেই শুরু হয় উপন্যাসের। এই দায়িত্ব হস্তান্তর
ছিল ভিন্ন ধরনের। অসুস্থ সন্তানকে সুস্থ করতে বাবর হুমায়ুনের ব্যাধি নিজ শরীরের নেন
এবং মৃত্যু বরন করেন। তার তিন দিনের মাথায় সিংহাসনে বসেন হুমায়ুন। এরপর শুরু হতে থাকে
এই বিচিত্র চরিত্রের অধিকারী সম্রাটের খামখেয়ালিপনা। খামখেয়ালিপনা একটি উদাহরণ হতে
পারে, তিনি নিজের কথা রাখার জন্য এক ফকিরকে অর্ধবেলার জন্য নিজের সিংহাসন ছেড়ে দেন।
দিল্লির এই সম্রাটের যুদ্ধজয় বা বীরত্বগাথা কোনটাই
ছিল তার জীবনে। জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে রাজ্যহীন হয়ে। তারপরও তার মহানুভবতা দেখে,
আপনি অন্য এক সম্রাটকে খুজে পাবেন। তিনি তার বাবার কথা রাখার জন্য তার বিশ্বাসঘাতক
ভাইদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করার অধ্যবসায়ে রবার্ট ব্রুচকেও হার মানিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত
হুমায়ুন দেখিয়েছেন ছেলের প্রতি মায়ের ভালোবাসার চেয়েও তার ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা কত
গাঢ়।
শুধু ভাইদের
প্রতি ভালবাসা না, রাজ্যহীন সম্রাট ভালবেসেছিল হামিদা বানু নামের একজন রূপবতীকে। প্রথমে
হামিদা রাজি না হলেও, পরে সর্বহারা এই সম্রাটকে বিয়ে করে পথে পথে ঘোরে কয়েক বছর। এই
দম্পতির সন্তানই ছিল ইতিহাসের সেই নামকরা বীর, আকবর দ্যা গ্রেট; যাকে নিয়েও এমন একটা
বই লেখা যায়।
হুমায়ুনের
মানুষকে বশ করার ক্ষমতা এতটাই ছিল যে, তার শত্রু শের শাহ তার সাম্রাজ্য দখল করার পরও
আদেশ দিয়েছিলেন হুমায়ূনকে যেন পালাতে দেওয়া হয়। হুমায়ুন তার মহানুভবতা দিয়ে জয় করে
নিয়েছিলেন শত্রুর হৃদয়ও।
এসবের পাশাপাশি
মোঘল সাম্রাজ্যে স্বর্ণাক্ষরে যার নাম লেখা আছে সে হল প্রধান সেনাপতি বৈরাম খাঁ। যে
ছিল হুমায়ুনের প্রধান শক্তি। সব হারানোর পর একাই হুমায়ুনের পক্ষে শেষ পর্যন্ত কিছু
ফিরে পাওয়ার সম্ভবনা ছিল না সেটা হুমায়ুন স্বয়ং নিজেই জানতেন। তবে এই অসাধ্য একাই করে
দেখিয়েছিলেন এই বীর যোদ্ধা বৈরাম খাঁ। হুমায়ুনকে বিশ্রাম দিয়ে একাই মোঘল সাম্রাজ্য
ফিরিয়ে আনেন। শত্রুদের থে্কে উদ্ধার করেন ছোট আকবর দি গ্রেটকে। এজন্য হুমায়ুন তাকে
উপাধি দেন ‘খান
খানান’ তথা রাজাদের রাজা। সত্যিকার অর্থে এই সেনাপতি ছাড়া
মোঘল সাম্রাজ্য তার ক্ষমতা সেই সময় চিরতরে হারাত। এজন্য শের শাহ রাজ্য দখলের পর এই
সেনাপতিকে হত্যা করার নির্দেশ দেন; শুধু ভাগ্য জোড়ে বেচে যান তিনি। উপন্যাসটিতে এই
বীর যোদ্ধার বিদায় এমন ভাবে হয়েছে, যা সকল
পাঠকের হৃদয়ে দাগ দিয়ে যাবে। তবে মোগল ইতিহাস থেকে বৈরাম খাঁ-র বিদায় নিয়ে অনেক রকম
তথ্যই পাওয়া যায়, যা আবার এই বইয়ের সাথে সংগতিপূর্ণ না।
এসব প্রধান
চরিত্রের পাশাপাশি হরিশংকরের মতো বিশ্বাসঘাতকদের
তুলে এনেছিলেন লেখক। দেখিয়েছেন তৎকালীন সমাজব্যবস্থাকে, বিরোধীতা করেছেন সতীদাহের,
বলা হয়েছে মানুষকে পুড়িয়ে মারার মতো ঘটনার কথা; যা সম্পূর্ণ উপন্যাসের অলংকরনের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়
ছিল। পাশাপাশি সাহিত্যে সমৃদ্ধ সেই মোঘলদের কিছু শের/কবিতা উপন্যাসের সৌন্দর্যতা বাড়িয়ে
দিয়েছে। যেমন শের শাহ হুমায়ুনের কবিতা আবৃতি করতে গিয়ে বলেছেন,
‘অশ্ব অশ্বারোহীর বন্ধু নয়।যেমন বন্ধু নয় বায়ু, মেঘমালার।বন্ধু হবে এমন যাদের সঙ্গে কখনো দেখা হবে না।দু'জনই থাকবে দু'জনের কাছে অদৃশ্য।দৃশ্যমান থাকবে তাদের ভালোবাসা।’
আবার স্ত্রী
হামিদা বানুর অনুরোধে সম্রাট হুমায়ুনের বলেছেন-
‘একজন প্রেমিকের কাছে চন্দ্র হলো তার প্রেমিকার মুখ। আর জোছনা হলো প্রেমিকার দীর্ঘশ্বাস।’
এই উপন্যাস
নিয়ে জনপ্রিয় বিতর্কটা হলো; উপন্যাসে বলা আছে, গ্রহ নক্ষত্র অনুযায়ী একেক দিনে একেক
রঙের পোশাক পরতেন হুমায়ুন। মঙ্গলবারে পরতেন মঙ্গলগ্রহের লাল রঙের পোশাক। পনের শতকে
তিনি কীভাবে জানল যে মঙ্গল গ্রহ লাল, সেটি অবশ্যই ভাবনার। যদিও উপন্যাসটি লেখার জন্য
হুমায়ুন আহমেদ অনেক রেফারেন্স বইয়ের আশ্রয় নিয়েছেন। তারপরও এটির কুলকিনারা করা মুশকিল!
আমাদের ইতিহাসের
কোণায় কোণায় যে কত সৌন্দর্যতা লুকিয়ে আছে তা বুঝতে এই বইয়ের কোন বিকল্প নেই। পাঠ্যবইয়ের
ইতিহাস বলতে আমরা বুঝি, কোন সম্রাট কত সনে কাকে পরাজিত করল আর কার বংশধর কে; ব্যাস
এটুকুই! এর বাহিরেও এইসব ইতিহাসের প্লট যে কোন সিনেমার থেকেও নাটকীয়তা পূর্ণ, তার অন্যতম
নিদর্শন এই বইটি। যেকোন ধরনের পাঠকের ভালোলাগার মতো বই এটি।
মোঃ
রাজিবুল ইসলাম
কনীনিকা
কুঞ্জ, নারুলী।।
No comments