Header Ads

হাজার চুরাশির মা


হাজার চুরাশির মা (১৯৭৪); মহাশ্বেতা দেবী: ৮.৬ 

যারা বই নিয়ে একটু আধটু খোঁজ খবর রাখেন বা বই নাড়াচাড়া করেন তারা অবশ্যই “হাজার চুরাশির মা” এর নাম শুনে থাকবেন। অনেক নামীদামি বা গুণী লেখকের কাছে পছন্দের তালিকার একটি উপন্যাস। বাংলার উপন্যাসকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে এমন কিছু বই অনেক ভূমিকা রেখেছে। তাই মনোনীত হয়েছিল জ্ঞানপীঠ পুরষ্কারের; যা মহাশ্বেতা দেবী গ্রহণ করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা সংগ্রামী ও রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলার থেকে।
এই বইটিতে আছে একটা পরিবারের গল্প, একটা মায়ের গল্প। শুধু মা নয়, একটা ছেলে হারানো মায়ের গল্প। আরও ভালভাবে বলতে গেলে আসলে সব মায়ের গল্প। এক মা তার হারানো সন্তানের গল্প খুজতে গিয়ে, তুলে এনেছে সব মায়ের কথা। সব মা একই আদলে তৈরী, তবে এই মা সবাইকে তা বলতে পেরেছিলেন।
 এই গল্পের মা চরিত্রটি হল ‘সুজাতা’। যখন নকশাল আন্দোলন হাজার হাজার তরুণ নিহত হয়েছিল, তখন তার মধ্যে ছিল তার আদরের সন্তান ‘ব্রতী’। সুজাতার আরও তিনটি সন্তান (জ্যোতি, নিপা, তুলি) থাকলেও তাদের সাথে মা’র সম্পর্ক ব্রতীর মতো ছিল না। বাকি তিন সন্তানের ঝোঁক ছিল বাবার দিকে। বাবার প্রসঙ্গটাতে পরেই আসি।
নকশাল আন্দোলনে পার্টির ভেতরকার বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বিরোধীদের হাতে নিহত হয়েছিল অনেক তরুন। এসব তরুণদের ছিল আদর্শ প্রীতি। নিহতদের মধ্য ব্রতীর লাশ ছিল ১০৮৪ নম্বর। এখান থেকেই হয় বইটির নামকরণ।
‘সুজাতা’র মতো মায়েরা এতটাই অসহায় ছিল সে সময় যে, সন্তান জন্মদানের জন্য একা থাকতে হতো হাসপাতালে। পরিচিত কেউ পাশে থাকত না। তারপরও মৌন প্রতিবাদ করে সে সংসার চালিয়ে যাচ্ছিল। যদিও ব্রতীর এটি পছন্দের ছিল না।
ব্রতী ছিল সংস্কৃতিমনস্ক, যে কিনা কবিতা লিখত। তবে আদর্শগত আর পারিবারিক কারণেই জড়িয়ে পরে নকশাল আন্দোলনে। এর পাশাপাশি উপন্যাসে নন্দিনী নামের এক মেয়ের কথাও আছে। ব্রতী ভালবাসতো তাকে আর মেয়েটিও ছিল নকশালপন্থী।
উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে এক অদ্ভুদ সমাজের চিত্র,  দেখানো হয়েছে সেখানকার পুরুষদের ক্ষমতা। এর জন্য লেখিকা ব্যবহার করেছেন ‘সুজাতা’র স্বামী দিব্যনাথকে। দিব্যনাথ ছিল উচ্চ পর্যায়ে ধনী। তার কাছে স্ত্রীর প্রয়োজন ছিল শুধুমাত্র সন্তান জন্মদানের জন্য। এর বাইরে মানবিক কোন সম্পর্ক ছিল না তার স্ত্রীর সাথে। অন্য মেয়েদের সাথে অবাধ মেলামেশাও ছিল দিব্যনাথের। তবে এসব নিয়ে দিব্যনাথের মা বা দিব্যনাথে তিন সন্তান জ্যোতি, নিপা আর তুলির কোন আপত্তি ছিল না। তাদের কাছে ব্যাপারটা ছিল পৌরষ্যত্বের। তবে ব্রতী এসবের পক্ষে ছিল না। তাই আদর্শগত দিক থেকে সে তার মায়ের দিকে ছিল। বাবার সাথে এই দূরত্বের জন্য বাবাকে ‘বস’ বলেই ডাকত।
ব্রতীর মৃত্যুর পর সেই খ্যাতনামা বাবা সমাজে নিজের ভাবমূর্তি ঠিক রাখতে চেষ্টা করেছে তার সন্তানের পরিচয় গোপন করার। খবরের কাগজে সবার নাম থাকলেও, নিজের ছেলেরটা ক্ষমতা জোরে আটকিয়ে দেয়। মুছে ফেলে হাজার চুরাশির পরিচয়। তবে এসব নিয়ে লজ্জিত ছিলেন না ‘সুজাতা’। কারণ তিনি মা। তিনি সারাদিন খুঁজে বেরিয়েছে এসবের পেছনের গল্প। বুঝেছেন শুধু তিনি না, ব্রতীও তাকে কতটা ভালবাসতো, কতটা ভাবত তাকে নিয়ে।
এসবের পাশাপাশি উঠে এসেছে ব্রতীর বন্ধু সমু, পার্থ, বিজিত আর লালটুর কথা এবং এদের পরিবারের কথা। এছাড়াও ‘হেম’ নামের একটি চরিত্রের উল্লেখ্য পাওয়া যায়, ব্রতীর কাছে যার অবস্থান ছিল মায়ের পরেই। বইটিতে দেখানো হয়েছে, সমাজের এই অবহেলিত চরিত্রগুলো তাদের পছন্দের মানুষকে হারালেও কান্না করতে পারে না।
সর্বপরি, অসম্ভব ভালোলাগার মতো একটি উপন্যাস এটি। একজন মায়ের চিন্তা ভাবনা, একটি বিপ্লবী আন্দোলন বা সেই আদিম সমাজের চিত্র পুরোটাই তুলে আনতে পেরেছেন মহাশ্বেতা দেবী, আপনার আকাশে একবিন্দু জলকণা তৈরিতে তা যথেষ্ট। ভালো থাকুক পৃথিবীর সব মা।


মোঃ রাজিবুল ইসলাম
কনীনিকা কুঞ্জ, নারুলী।।


No comments

Powered by Blogger.